বৈশ্বিক মহামারী করোনা পরিস্থিতি লকডাউনের স্মৃতিতে লেখা “রক্তের সম্পর্ক থাকলেই মানুষ আপন হয় না; কখনও কখনও আত্মার বন্ধনই রক্তের সম্পর্ককেও হার মানাতে পারে।”
২০২০ সালের বসন্তের শুরুতে পৃথিবী যেন থমকে গিয়েছিল। সারাদেশ লকডাউনের মধ্যে মানুষ ভয়ে কাঁপছিল। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মানেই মৃত্যুর আশঙ্কা। শহর-গ্রাম—সব জায়গা যেন ধ্বংসস্তূপের মতো নিস্তব্ধ।
পত্রিকা ও টেলিভিশন প্রতিদিন জানাচ্ছিল, কেউ জ্বর বা কাশির মতো সামান্য উপসর্গ পেলেই পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী—প্রিয়জন আক্রান্ত হলে নিজের নিরাপত্তার জন্য অনেকেই তাকে একা ফেলে চলে যাচ্ছিল। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এই অন্ধকার সময়ে কিছু মানুষ মানবতার পতাকাধারী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তারা করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃতদের দাফন করেছেন, আবার খাবার ও সহায়তা পৌঁছে দিয়েছেন তাদের কাছে—যারা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মধ্যে হাহাকার করছিলেন।
সেইসব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর নাম আজও স্মৃতিতে অমলিন—
✅ আল-মারকাযুল ইসলামি বাংলাদেশ
✅ মাস্টুল ফাউন্ডেশন
✅ তাকওয়া ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
✅ পাথওয়ে বাংলাদেশ
✅ মান ফর ম্যান ফোর্স
✅ আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন
✅ বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি
টেলিভিশনে দেখতাম—চীন পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রতিদিন হাজারো মানুষ মারা যাচ্ছে। আমাদের দেশেও প্রতিদিন ২০ থেকে ৫০ জনের মৃত্যু হচ্ছিল। এমনকি ছোট জ্বর, ঠান্ডা বা কাশিতেও মানুষ ভয় পেত। কেউ মারা গেলে মৃতদেহ দাফনের দায়িত্ব নিতেন এই স্বেচ্ছাসেবকেরাই।
এই সংগঠনগুলো ছাড়াও আরও অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এই মহৎ কাজে যুক্ত ছিলেন—যাদের নাম আমার জানা নেই।
লকডাউনে আমরা মধ্যবিত্তরা ঘরে বন্দী থাকলেও কিছুটা নিরাপদ ছিলাম। হাতে খাবার ছিল, পকেটে গচ্ছিত টাকা ছিল—যা দিয়ে অন্তত কয়েক মাস বসে খাওয়া সম্ভব। স্নেহময় আশ্রয়ও ছিল।
কিন্তু শহরের দিনমজুর, রিকশাচালক, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ, পথশিশু ও দুঃস্থ পরিবার? আমার চোখে ভাসত তাদের অসহায় চাহনি—বৃদ্ধরা, পথশিশুরা, দারিদ্র্যপীড়িত পরিবার—মৃত্যুর ভয় ও ক্ষুধায় কাঁপছে। কেউ রোদে, কেউ বৃষ্টিতে, কেউ রাস্তায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে; খাবারের জন্য হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকারি সাহায্য ছিল অপ্রতুল। তবুও কিছু বিত্তবান ও রাজনীতিবিদ —ভয় থেকে হোক বা লোক দেখানো কিংবা অন্তরের তাগিদে—নিজস্ব অর্থে সহায়তার হাত বাড়িয়েছিলেন।
এক শ্রেণির বৃত্তবানরা গরীব অসহায় কর্মহীন মানুষের একহাতে খাবার দিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিতেন, পেপার পত্রিকায়, নিউজ পোর্টালে প্রচার করতেন। কিছু মানুষ তখন মন থেকে মানবতার প্রদীপ জ্বালিয়ে, ভালোবাসা ও সহানুভূতির আলো ছড়িয়ে—দুঃখের আঁধার কিছুটা হলেও হ্রাস করছিলেন। আজও মনে আছে লকডাউনের দিনগুলোর দৃশ্য—বগুড়ার সাতমাথা, তিনমাথা, চারমাথা এলাকা যেন এক মরুভূমি। নীরবতা, ফাঁকা রাস্তা—মানুষের দেখা নেই।
যেখানে স্বাভাবিক দিনে বা ঝড়-বৃষ্টিতেও সাতমাথায় শত শত অটোরিকশা,পা রিকশা,মোটরসাইকেল,প্রাইভেট কারের ভিড়ে তীব্র যানজট থাকে—সেই জায়গা লকডাউনে সম্পূর্ণ ফাঁকা। একদিন সন্ধ্যায় বউবাজার এলাকার সাংবাদিক হায়দার আলী মিঠু ভাইয়ের সাথে কিছু বিষয় আলোচনা করতে সাতমাথায় গেলাম। গিয়ে দেখি—আমরা দু’জন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য ছাড়া আর কেউ নেই।
বগুড়া রেড জোন ঘোষিত হওয়ায় শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাঁশ দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
ঢাকা থেকে বিশেষকরে গ্রামাঞ্চলে কারও বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসলে পরীক্ষা না করেই তার বাড়ির সামনে লাল পতাকা গেঁড়ে দেওয়া হতো।
একদিন বিকেলে আমার মোবাইলে কল এল। কলদাতা—সম্পকে আমার ভাতিজি—জানালো, শেরপুরের ভবানীপুর ইউনিয়নের আফরাতগাড়ী গ্রামের মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নানের বাড়িতে মাদারীপুর থেকে তার একটি মেয়ে এসেছে। ইউনিয়নের দুই গ্রাম পুলিশ লাল পতাকা গেঁড়ে দিয়েছে। আমি নিজে ফোন করে সেই পতাকা সরাতে বললাম, তারা সরিয়েও নিল। তবু আমার মনে ভয় কাজ করছিল—একা পরিবার নিয়ে থাকি, যদি করোনা আক্রান্ত হই, পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। নিরাপত্তাহীনতা, অন্ধকার, অজানা আশঙ্কা—সব মিলিয়ে মন ভেঙে পড়েছিল। শহরে থাকা আর সম্ভব নয়। ভাবলাম—কয়েকদিন গ্রামের বাড়িতে থাকবো; দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হলে শহরে ফিরবো। এই ভেবে আমি এক রক্তের আত্মীয়কে ফোন করলাম। তিনি বললেন—“তুমি এলে আমাদের বাড়ি লোকজন আসা বন্ধ করবে,আমরা কোথাও যেতে পারব না।” কিছুক্ষণ নীরব রইলাম।
তারপর কর্মসূত্রে পরিচিত আমার প্রিয় অভিভাবক বোন ও দুলাভাইকে ফোন করলাম। তারা ঢাকার মিরপুরে থাকেন। আমি বললাম—“আমাদের এখানে কেউ নেই। অনেক ভয় হচ্ছে। যদি আমরা করোনা আক্রান্ত হই, তাহলে কি হবে?” দুলাভাই ও বোন এক বাক্যে বললেন—“আমরা আপনার পাশে আছি। গাড়ি পাঠাচ্ছি, ঢাকায় চলে আসুন।” সেই মুহূর্তে বুঝলাম—রক্তের সম্পর্ক থাকলেই মানুষ আপন হয় না; কখনও কখনও আত্মার সম্পর্কই জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয় হয়। ছোটবেলায় আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন। কোনো অভিভাবক ছিল না, কোনো বোনও ছিল না—ছোটবেলা থেকেই দুঃখে ভরা জীবন। কিন্তু সেই বোন-দুলাভাই—যাদের সাথে কর্মসূত্রে পরিচয়, কয়েকবার ফোনালাপ হলেও কখনো সাক্ষাৎ হয়নি তখন—তারা কিছুদিনের সম্পর্কেই আমাকে আপন করে নিলেন।
আমার প্রয়োজন পড়েনি বলে আমি তখন তাদের কাছে যাইনি, কিন্তু বিপদের দিনে তারা নিঃস্বার্থভাবে সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
সেই ভালোবাসা, সহানুভূতি ও মানবিকতার উদাহরণ আজও আমার হৃদয়ে অমলিন। তারা বলেছিলেন— ❝বাঁচতে হলে একসাথে বাঁচবো, মরতে হলে একসাথে মরবো।❞ এই কথার প্রকৃত মানে আমি সেই কঠিন সময়ে উপলব্ধি করেছি। দুঃখ, কষ্ট, মৃত্যু, ভয়—সব মিলিয়ে ছিল এক অজানা যন্ত্রণা। কিন্তু ভালোবাসা ও মানবিকতা সেই যন্ত্রণাকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছিল। আজও আমি অন্তরের অন্তস্থল থেকে আমার প্রিয় বোন ও দুলাভাইকে ধন্যবাদ জানাই। মহান আল্লাহ তাঁদেরকে সপরিবারে সবসময় সুস্থ ও ভালো রাখুন।
লেখক:
মোঃ মাহিদুল হাসান সরকার
প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ সেন্ট্রাল প্রেস ক্লাব (B.C.P.C) ও সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি জাতীয় দৈনিক মাতৃজগত পত্রিকা।